শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০৬ অপরাহ্ন
রেজাউল করিম রেজা,ময়মনসিংহ : ৮০ দশকে ছিলেন নির্মান শ্রমিক। তার মাঝামাঝি সময়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। রাজনীতিতে প্রবেশ করেন মুক্তাগাছার বিল্লাল হোসেন সরকার। এরপর কিছু সময় যুবলীগ এবং ২০০৫ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিবার্চিত হয়েছেন। সবশেষ দলীয় প্রতীক নিয়ে ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারী পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ক্ষমতার দীর্ঘ বছরে উপজেলার সর্বত্রই নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখল, চাঁদাবাজি, হামলা এবং সাধারন মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করাই ছিল তার কাজ। আওয়ামীলীগ সরকারের ১৫ বছরে ময়মনসিংহ মুক্তাগাছায় দুইবার আওয়ামীলীগ, একবার জাতীয় পার্টি এবং সবশেষ কৃষক লীগ নেতা স্বতন্ত্র হিসেবে সংসদ সদস্য নিবার্চিত হন।
২০০৮ ও ২০১৮ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে নিবার্চিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কে এম খালিদ। খালিদ বাবু দুই মেয়াদে উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় একক আধিপত্য বিস্তার করেন বিল্লাল হোসেন সরকার। তাঁর নেতৃত্বেই স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি গঠন, নিয়োগ, দখলদারিত্ব এবং চাঁদাবাজি ও মেয়ের জামাতা যুবলীগ নেতা মনিরকে দিয়ে করাতেন মাদক ব্যবসা। আর এসব করে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি কোটি টাকা। ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নিবার্চিত হওয়ার পর কেএম খালিদ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন বিল্লালও তার জামাতা মনির। ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে নিজে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি মেয়ের জামাতা মাহবুবুল আলম মনিকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত করান। পান থেকে চুন খসলেই ভিন্ন আদর্শের মানুষের ওপর চলতো বিল্লাল বাহিনীর নির্যাতন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কিছুদিন আগে পৌরসভার দোকান বরাদ্দ ও ১১টি পদে নিয়োগ দিয়ে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিল্লাল হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে।
পৌরসভার তত্ত্বাবধানে নির্মিত দু’তলা পৌর শপিং কমপ্লেক্সের ৫৬টি দোকান বরাদ্দ দিয়ে ৪ কোটি টাকা বিল্লাল হাতিয়ে নেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সে গা ঢাকা দেওয়ায় দুইজন ব্যবসায়ী তাঁর নামে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন। মামলার বাদি আল আমিন প্রতিদিনের কাগজকে বলেন, মার্কেটে আমার পুরাতন দুটি দোকান আগে থেকেই ছিল। ওই পুরাতন দুই দোকান এবং নতুন একটি নিয়ে আমরা দুই ভাই বিল্লাল হোসেন সরকারকে ২৯ লাখ টাকা দিয়েছি। আমাদের কাছে টাকা দেওয়ার রশিদও রয়েছে। টাকা পাওয়ার অনিশ্চিয়তা দেখে আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করেছি। গত ২৭ আগস্ট আমি এবং আব্দুর রশিদ নামে আরেক ব্যবসায়ি পৃথক দুটি মামলা করি। কিন্তু মার্কেটে ইহা সরকারি সম্পত্তি এমন একটি সাইনবোর্ড সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ টানিয়েছে। তিনি আরও বলেন, মেয়রকে আমরা কয়েকজন ব্যবসায়ি দোকান বরাদ্ধের জন্য ৯৮ লাখ টাকা দিয়েছি, যার রশিদ রয়েছে। কিন্তু আরও অনেকে টাকা দিয়েছে যার রশিদ নেই। সবমিলিয়ে মেয়রকে ৪ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। পৌরসভার বাজার পরিদর্শক মো.কামরুজ্জামান বলেন, দোকান পাওয়ার আশায় প্রত্যেক ব্যবসায়ি সাবেক মেয়র বিল্লাল সাহেবকে ১ থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়েছে। এই টাকা মেয়র ব্যক্তিগত ভাবে নিয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে ব্যবসায়িরা বিপাকে পড়েছে।
সম্প্রতি মার্কেটের জায়গা নিয়ে একটি মামলা হওয়ায় সেখানে সকল ধরণের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি পৌরসভার ১১টি পদে স্বজনপ্রীতি ও মোটা অংকের টাকা নিয়ে দেয়া হয়েছে নিয়োগ। সড়ক বাতিপরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিল্লাল হোসেনের ভাগনে মেহেদী হাসান, সুপারভাইজার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারি শাহরিয়ার রাকিব, স্টোরকিপার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সাবেক প্যানেল মেয়র মনিরুজ্জামান দুদুর মেয়ে মৌসুমী আক্তারকে। বাকি নিয়োগপ্রাপ্তদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে মোটা অংকের টাকা। সুপারভাইজার পদে নিয়োগ পাওয়া শাহরিয়ার রাকিব বলেন, যথাযথ প্রক্রিয়ার মধ্যে আমার নিয়োগ হলেও মানুষ বিষয়টিকে ভিন্ন ভাবে নিচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বেশি চাপে আমি রয়েছি। আজ মঙ্গলবার (১লা অক্টোবর) আমাকে শোকজ করা হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতায়ও ভুগছি। আমি আগে সাবেক মেয়র বিল্লাল হোসেন সরকারের বিভিন্ন প্রোগ্রামের ছবি তুলতাম। তিনি নিয়মিত আমাকে বেতন দিতেন।
পারিবারিক লীগ প্রতিষ্ঠা:
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে নিজের পাল্লা ভারী করতে বিল্লাল হোসেন সরকার বড় মেয়ের জামাতা ছাত্রদল নেতা মাহবুবুল আলম মনিকে যুবলীগে প্রবেশ করান। মনি যুবলীগে প্রবেশ করে শ্বশুরের ছত্রছায়ায় অটোরিকশা ও টেম্পু থেকে চাঁদাবাজি, চিকিৎসককে মারধর, যুবলীগ নেতা আসাদ হত্যা,মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের নেতৃত্বদেন। শ্বশুরের কল্যাণে প্রায় চার বছর আগে উপজেলা যুবলীগের সভাপতি হন তিনি। গেল জেলা পরিষদ নিবার্চনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সদস্য হন মনি। এছাড়া বিল্লাল হোসেন তাঁর ভাই, ভাতিজা ও নিজ বলয়ের লোকজনকে আওয়ামী এবং সহযোগি সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন।
বড় পরিবারে জন্ম গ্রহণ করা স্বশিক্ষায় শিক্ষিত বিল্লাল হোসেন সরকারের কর্ম ঘানি টেনে শুরু হলেও রাজনীতিতে প্রবেশ করে প্রভাব খাটিয়ে বনে যান কোটি কোটি টাকার মালিক। মুক্তাগাছায় নামে-বেনামে দখল করেন সাধারণ মানুষের জায়গা জমি। মুক্তাগাছা শহরে কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে নিমার্ণ করেন দৃষ্টিনন্দন ডুপ্লেক্স বাড়ি, নিজস্ব জায়গায় রয়েছে মুন সিনেমা হল, মৎস্য প্রজেক্টসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে কয়েক একর জমি, ময়মনসিংহ শহরের নতুন বাজারে রয়েছে বিলাশবহুল ফ্ল্যাট, ঢাকার গুলশানে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। কানাডা প্রবাসী মেজো মেয়ে সনিয়া সরকারকে সেখানে বাড়ি কিনে দেওয়ার খবর চাউর রয়েছে। শিক্ষক আজহার উদ্দিন বলেন, বিগত সরকারের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যতগুলো নিয়োগ, কমিটি হয়েছে বেশির বিল্লাল সরকারের বাসায় বসে হয়েছে। খালিদ বাবু মুক্তাগাছার মানুষ না হওয়ায় সকল দায়িত্বপালন করতেন বিল্লাল। আর এসব করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই তিনি শতশত কোটি টাকা কামিয়েছেন। দুদুক বিষয়টি তদন্ত করলে তাঁর শতভাগ প্রমাণ পাবে।
স্থানীয় লিয়াকত আলী বলেন, আওয়ামী লীগের সময় মুক্তাগাছায় বিল্লালের কথা ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে নাই। পটপরিবর্তনের পর এলাকায় শান্তি এসেছে। বিল্লাল হোসেন সরকার পারিবারিক লীগ প্রতিষ্ঠা করে দলীয় নেতাদের মধ্যে যেমন বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষকে হয়রানিও করেছে। উপজেলা থেকে সকল ধরণের চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য বিল্লাল ও তাঁর লোকজন করত। পৌরসভায় বেশ কয়েকটি নিয়োগ দিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। একটা সময় তাদের করুণ অবস্থা থাকলেও আওয়ামী লীগের সময়ে গাড়ি, বাড়ি দেশের বাহিরে বাড়িসহ কয়েকশো কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। মুক্তাগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই আকন্দ বলেন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিল্লাল হোসেন সরকার ও খালিদ বাবু আজান দিয়ে দুর্নীতি করেছে। এটি সকলেই জানে। দোকান বরাদ্দের নামে ব্যবসায়িদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয়টিও আমি শুনেছি। এই দুইজন মুক্তাগাছা আওয়ামী লীগে বিভেদ তৈরির মূলহোতা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন বিল্লাল হোসেন সরকার ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এবিষয়ে বিল্লাল হোসেনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাঁর মোবাইলটি বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।